ডা. মোহাম্মদ ইউনুস: একজন নোবেল বিজয়ীর সংগ্রামের গল্প।
ডা. মোহাম্মদ ইউনুস একজন বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ, যিনি বিশ্বের দরিদ্রতম মানুষের জীবন পরিবর্তনের জন্য একটি অতি সাধারণ ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করেন। তিনি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন, যা বিশ্বের প্রথম মাইক্রোক্রেডিট প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাত। তার এ উদ্যোগের জন্য তিনি ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন।
![]() |
ছবি: সংগৃহীত |
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা
ডা. মোহাম্মদ ইউনুস ১৯৪০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৬০ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি পরবর্তীতে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিল্ট ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
পেশাগত জীবন ও গ্রামীণ ব্যাংক
বাংলাদেশে ফিরে আসার পর তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় তিনি দরিদ্র মানুষের অবস্থা দেখে বিমর্ষ হয়ে পড়েন। এই অভিজ্ঞতা তাকে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার দিকে ধাবিত করে। ১৯৭৬ সালে তিনি চট্টগ্রামের একটি ছোট গ্রামে নিরীক্ষামূলকভাবে মাইক্রোক্রেডিট কার্যক্রম শুরু করেন, যা পরে ১৯৮৩ সালে সরকারীভাবে গ্রামীণ ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
মাইক্রোক্রেডিট ও তার প্রভাব
মাইক্রোক্রেডিট হলো এমন একটি ঋণ ব্যবস্থা, যেখানে দরিদ্র মানুষদের জামানত ছাড়াই ছোট ঋণ প্রদান করা হয়, যাতে তারা নিজেদের ব্যবসা শুরু করতে পারে এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে। এই ঋণ কার্যক্রম দারিদ্র্য বিমোচনে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে এবং বিশ্বের বহু দেশে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে।
নোবেল পুরস্কার ও বৈশ্বিক স্বীকৃতি
২০০৬ সালে ডা. ইউনুস এবং গ্রামীণ ব্যাংককে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয়। নোবেল কমিটি তার এই উদ্যোগকে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য এক অনন্য উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করে। তিনি জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন ধরনের সন্মাননা লাভ করেন।
সমালোচনা ও বিতর্ক
তবে, ডা. ইউনুসের কার্যক্রম নিয়ে বিতর্কও কম ছিল না। কিছু সমালোচক মনে করেন যে মাইক্রোক্রেডিট উচ্চ সুদের হার দরিদ্র মানুষদের জন্য অসুবিধাজনক। এছাড়া গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ও তার মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। ২০১১ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে অপসারণ করে, যা বিশ্বব্যাপী বিতর্কের সৃষ্টি করে।
ডা. মোহাম্মদ ইউনুস একজন দৃষ্টান্তমূলক ব্যক্তিত্ব, যিনি তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিশ্বের দরিদ্র মানুষদের জীবনমান উন্নয়নের প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন। তার মাইক্রোক্রেডিট ধারণা এবং গ্রামীণ ব্যাংকের মডেল বিশ্বের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য একটি নতুন আশা সৃষ্টি করেছে। যদিও তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সমালোচনা রয়েছে, তারপরও তার অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। ডা. মোহাম্মদ ইউনুসের সংগ্রামী জীবন ও কাজ আমাদের সকলেডা. মোহাম্মদ ইউনুসের জীবনের কাহিনী শুধুমাত্র একটি ব্যক্তির সাফল্যের গল্প নয়, বরং এটি মানুষের সংকল্প, উদ্ভাবনশীলতা, এবং দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটি প্রামাণ্য দলিল। তার উদ্যোগে লক্ষ লক্ষ মানুষ দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে।
সামাজিক ব্যবসা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ডা. ইউনুস কেবল মাইক্রোক্রেডিটের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি। তিনি সামাজিক ব্যবসার ধারণা প্রচলন করেছেন, যেখানে ব্যবসার লক্ষ্য শুধুমাত্র মুনাফা নয়, বরং সামাজিক সমস্যার সমাধানও। তিনি মনে করেন, সমাজের উন্নয়নের জন্য ব্যবসার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং তিনি এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন যেখানে মানুষ সমাজের উন্নয়নের জন্য ব্যবসা করবে।
তার প্রভাব এবং উত্তরাধিকার
ডা. ইউনুসের কাজের প্রভাব আজও বিশ্বব্যাপী লক্ষণীয়। বিভিন্ন দেশে মাইক্রোক্রেডিট প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক ব্যবসার ধারণা গ্রহণ করা হয়েছে। তার মডেলগুলোর অনুকরণে বহু দেশে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে যা মানুষের জীবনে আমূল পরিবর্তন আনছে।
তিনি তার জীবনের শেষ পর্যন্ত দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যেতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তিনি এমন একটি উত্তরাধিকার রেখে যাচ্ছেন যা সমাজের প্রতিটি স্তরে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ব্যক্তিগত জীবন
ডা. ইউনুসের ব্যক্তিগত জীবনও অত্যন্ত সাধারণ। তিনি একজন সাধারণ জীবনযাপনে বিশ্বাসী এবং তার কাজের প্রতি সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করেন। তার অনুপ্রেরণামূলক জীবনচরিত আমাদেরকে শিখায় যে সংকল্প, নিষ্ঠা, এবং সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে, এক ব্যক্তিও পুরো বিশ্বে পরিবর্তন আনতে পারে।
ডা. মোহাম্মদ ইউনুসের জীবন এবং তার উদ্যোগ একটি অসাধারণ প্রমাণ যে একজন ব্যক্তি কীভাবে সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলির সমাধানে নিরলস কাজ করতে পারেন। তার উদ্ভাবন এবং সামাজিক উন্নয়নের জন্য তার অবদানের কারণে তিনি বাংলাদেশের এবং বিশ্বের দরিদ্র মানুষের জন্য এক অমূল্য সম্পদ। ডা. ইউনুসের কাজের প্রভাব আরও বহু বছর ধরে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে এবং তার প্রবর্তিত ধারণাগুলি বিশ্বজুড়ে দারিদ্র্য বিমোচনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।র জন্য একটি প্রেরণার উৎস।